দই বছরের ছেলেকে বাসায় রেখে কাছেই বাজারে যান মা রেহেনা আক্তার আর সন্ধ্যার পরপরই আট বছরের মেয়ে । টিঅ্যান্ডটি কলোনির বাসায় ফিরে আসেন মা বাজারসদাই করে ২০ মিনিটের মধ্যে বনানীর কড়াইলের। দরজাটা ভেড়ানো দেখতে পান। তখন ডাক দেন রেহানা মেয়ের নাম (সাথি আক্তার) ধরে। কিন্তু সাড়াশব্দ পাননি ভেতর থেকে কোনো। একটু ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে যায় একপর্যায়ে দরজায়। দেখেন ওড়না প্যাঁচানো অবস্থায় ঝুলে আছে আট বছরের সাথি বাঁশের আড়ার সঙ্গে। মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন তিনি জোরে চিৎকার দিয়ে। নিচে পড়ে যায় গলার ফাঁস খুলতেই মেয়েটি। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু ততক্ষণে সাথি আর নেই। এ ঘটনা গত বুধবারের।
কাউকে সন্দেহ করেননি কে বা কারা তাঁদের মেয়েকে খুন করে ঝুলিয়ে রেখেছিল মেয়েকে হারিয়ে পাগলপ্রায় মা–বাবা। তাই মামলা করলেও কাউকে সন্দেহ করেননি বনানী থানায় খুনের। অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা করেন। তবে বনানী থানা-পুলিশ খুনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে খুনিকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করে। নাম ইয়ামীন হোসেন (৫২)। খুন হওয়া শিশুটির পাশের কক্ষে ভাড়া থাকেন। সঙ্গে থাকেন ২৮ বছরের এক ছেলে। বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নূরে আযম মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছোট্ট মেয়ে সাথির মা বাসা থেকে চলে যাওয়ার পরপরই বাসায় ঢুকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন আসামি ইয়ামীন। তখন সাথি চিৎকার দিয়েছিল। মুখ চেপে ধরে মেয়েটিকে শ্বাস রোধ করে মেরে ফেলেন। ঘটনাটিকে আত্মহত্যা হিসেবে সাজাতে সাথিকে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলিয়ে দেন। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। আমরা খুনি ইয়ামীনকে ধরে ফেলি। কড়াইলে টিঅ্যান্ডটি কলোনিতে দুই সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে আঞ্জু মিয়ার ভাড়া বাসায় এখন কেবলই শূন্যতা। তাঁদের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহে। ছোট্ট সাথি বনানীর স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ত।
খুন করে দরজার সামনে চুপচাপ বসে ছিলেন খুনি
বনানী থানা-পুলিশ এবং নিহত সাথি আক্তারের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ১২ বছর আগে ময়মনসিংহ থেকে কাজের সন্ধানে ঢাকায় আসেন বেকার যুবক আঞ্জু মিয়া, তখন তাঁর বয়স ছিল ১৮ বছর। প্রথমে বিভিন্ন বাসায় নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করতেন। পরে ব্যক্তিগত গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ নেন। এর মধ্যে রেহানাকে বিয়ে করেন। এই দম্পতির প্রথম সন্তান সাথি আক্তার। গাড়ি চালিয়ে এখন তাঁর বেতন সর্বসাকল্যে ১৭ হাজার টাকা। এই টাকায় তাঁর সংসার চলে। বছরখানেক আগে টিঅ্যান্ডটি কলোনির নিচতলায় বাসা ভাড়া নেন আঞ্জু মিয়া। ভাড়া তিন হাজার টাকা। আর ছয় মাস আগে তাঁদের পাশের কক্ষটি ভাড়া নেন ভোলার ইয়ামীন। ইয়ামীনও একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তাঁর স্ত্রী, সন্তান থাকে গ্রামের বাড়িতে। তিনি মোবাইল কোম্পানির টাওয়ার স্থাপনে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন।
সাথির বাবা আঞ্জু মিয়া সেদিন (বুধবার) ভোরবেলায় কাজে বেরিয়ে যান, তখন ঘুমাচ্ছিল সাথি। আর সন্ধ্যার সময় সাথি আর আবদুল্লাহকে বাসায় রেখে মা রেহানা যখন বাজারে যান, তখন বাসার সামনে বসে ছিলেন ইয়ামীন। বাসায় ফিরে যখন সাথি আক্তারকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পান মা রেহানা, তখনো সেখানেই বসে ছিলেন ইয়ামীন। তাই ঘুণাক্ষরেও তাঁকে সন্দেহ করেননি সাথির মা–বাবা কেউই। সাথি ইয়ামীনকে ‘আংকেল’ বলে ডাকত। তিনিও আদর করতেন।
সাথির চিৎকার বন্ধ করতে মুখ চেপে ধরেছিলেন ইয়ামীন
মা–বাবার সঙ্গে সাথি আক্তারফাইল ছবি
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বনানী থানার পরিদর্শক আলমগীর গাজী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছোট্ট সাথি খুনের মামলা তদন্ত করতে গিয়ে ঘটনাস্থলের আশপাশে যাঁরা বসবাস করেন, তাঁদের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করি। তখন জানতে পারি, সন্ধ্যার পর ইয়ামীন ছাড়া আর কোনো পুরুষ মানুষ তখন সেখানে ছিলেন না। তাই তাঁকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করি। প্রথমে ইয়ামীন সবকিছু অস্বীকার করছিলেন। তবে একপর্যায়ে স্বীকার করেন, সাথির মা বাসা থেকে চলে যাওয়ার পর ইয়ামীন বাসায় ঢুকে পড়েন। ৫ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যে সাথির মুখ চেপে ধরে ধর্ষণচেষ্টা চালান। তখন সে চিৎকার দেয়। আর মুখ চেপে ধরা অবস্থাতে সাথি শ্বাসরোধে মারা যায়। পরে ঠান্ডা মাথায় সাথির লাশ ঝুলিয়ে রেখে বাইরে এসে চুপচাপ বসে ছিলেন ইয়ামীন।
ইয়ামীন খুনের দায় স্বীকার করেন
ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে ইয়ামীন খুনের দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ধর্ষণচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে সাথিকে শ্বাসরোধে হত্যা করে লাশ ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। মামলা সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। রেহানা ইয়ামীনকে বলে গিয়েছিলেন খেয়াল রাখতে সাথির বাবা আঞ্জু মিয়া বলেন, ‘পুলিশ যখন ইয়ামীনকে ধরে থানায় নিয়ে যায়, তখন অবাক হয়েছি। পরে পুলিশ আমাকে জানিয়েছে, ইয়ামীনই আমার মেয়েকে হত্যা করেছে। আমরা কিন্তু ইয়ামীনকে ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করিনি। কারণ, খুন করার আগে আমার স্ত্রী ইয়ামীনকেই বলে গিয়েছিল, আমার ছেলেমেয়েকে যেন একটু দেখে রাখে। অথচ ওই ইয়ামীনই আমার মেয়েকে খুন করে দরজার সামনে চুপচাপ বসে ছিল। কোনো কিছুই আমাদের বলেনি।