আরবি ‘ফেতনা’ শব্দটি বিপদাপদ, পরীক্ষা করা, বিশৃঙ্খলা ইত্যাদি অর্থে ব্যবহার হয়। প্রত্যেক অপছন্দনীয় বস্তু ও বিষয়ের ক্ষেত্রেও শব্দটির ব্যবহার রয়েছে। পৃথিবী যতই এগিয়ে যাচ্ছে, নানারকম ফেতনা ততই দৃশ্যমান হচ্ছে। সামাজিক অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণের সব সরঞ্জাম হাতের মুঠোয় থাকায় চারিত্রিক অবক্ষয়ও একদম তলানিতে। দিন যতই যাচ্ছে, নানা সংকট যেন আরো বেশি ঘনীভূত হচ্ছে। তাই ফেতনা থেকে আত্মরক্ষা প্রতিটি মানুষের জন্য অপরিহার্য। নবীজি (সা.) বলেন, ‘শিগগিরই ফেতনা রাশি রাশি আসতে থাকবে। ওই সময় উপবিষ্ট ব্যক্তি দাঁড়ানো ব্যক্তির চেয়ে উত্তম (নিরাপদ), দাঁড়ানো ব্যক্তি ভ্রাম্যমাণ ব্যক্তি থেকে বেশি রক্ষিত। আর ভ্রাম্যমাণ ব্যক্তি ধাবমান ব্যক্তির চেয়ে বেশি বিপদমুক্ত। যে ব্যক্তি ফেতনার দিকে চোখ তুলে তাকাবে, ফেতনা তাকে গ্রাস করবে। তখন যদি কোনো ব্যক্তি তার দ্বীন রক্ষার জন্য কোনো ঠিকানা অথবা নিরাপদ আশ্রয় পায়, তাহলে সেখানে আশ্রয় গ্রহণ করাই উচিত হবে।’ (বুখারি: ৩৬০১)
যেভাবে ফেতনা থেকে বাঁচা যায়
তাকওয়া অবলম্বন
তাকওয়া বা আল্লাহভীতি মুমিনের অনিবার্য একটি গুণ। এই গুণ অর্জনের মাধ্যমে একজন মুমিন খুব সহজে ফেতনা থেকে বাঁচতে পারে। কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাকওয়ার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। তাবেয়িদের যুগে একবার ফেতনা দেখা দিলে লোকজন তালক ইবনে হাবিবের কাছে এসে জানতে চাইলেন যে, চারদিকে অনেক ফেতনার প্রকাশ ঘটেছে, আমরা কীভাবে এর থেকে নিরাপদে থাকব? তিনি বলেন, তাকওয়ার মাধ্যমে।’ (আজ-জুহদু ওয়ার-রাকাইক: ১/৪৭৩)
ভালো কাজ করা
সৎকর্ম মুমিনের অন্যতম গুণ। এ কর্মের মাধ্যমেই একজন মুমিন ফেতনা থেকে বাঁচতে পারে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আঁধার রাতের মতো ফেতনা আসার আগেই তোমরা সৎ আমলের দিকে ধাবিত হও। সেসময় সকালে একজন মুমিন হলে বিকেলে কাফের হয়ে যাবে। বিকেলে মুমিন হলে সকালে কাফের হয়ে যাবে। দুনিয়ার সামগ্রীর বিনিময়ে দ্বীন বিক্রি করে বসবে।’ (মুসলিম: ২১৩)
জামাতবদ্ধ থাকা
ইসলাম একাকী বা বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন সমর্থন করে না। ইসলামের নির্দেশ হচ্ছে, সমাজবদ্ধতা বা মুসলিমদের জামাত আঁকড়ে ধরা। হুজাইফা ইবনে ইয়ামান (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা মুসলিমদের জামাত ও ইমামের সঙ্গে আঁকড়ে থাকবে।’ আমি বললাম, যদি তাদের কোনো জামাত বা ইমাম না থাকে? তিনি বলেন, ‘তাহলে সেসব বিচ্ছিন্নতাবাদ থেকে তুমি আলাদা থাকবে, যদিও তুমি একটি বৃক্ষমূল দাঁত দিয়ে আঁকড়ে থাক এবং এ অবস্থায়ই মৃত্যু তোমার নাগাল পায়।’ (মুসলিম: ৪৬৭৮)
কোরআন ও সুন্নাহর বিধান আঁকড়ে ধরা
প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণ ও যাবতীয় ফেতনা থেকে আত্মরক্ষার আরেকটি কার্যকরী উপায় হলো, ইসলামি শরিয়তের দুই উৎস— কোরআন ও সুন্নাহর বিধানকে নিজেদের জীবনের জন্য অপরিহার্য করে নেয়া। যারা ইসলামের এই দুই উৎসকে আঁকড়ে ধরবে, তারা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি তোমাদের কাছে দুই বস্তু রেখে যাচ্ছি। তোমরা যতক্ষণ তা ধরে থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত পথভ্রষ্ট হবে না। তা হলো, আল্লাহর কিতাব ও তার নবীর সুন্নত।’ (মুয়াত্তা ইমাম মালেক: ১৬০৪)
ফিতনা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা
যে কোনো অকল্যাণ থেকে মুক্তির জন্য দোয়া মুমিনের অন্যতম হাতিয়ার। দোয়াকারীকে আল্লাহ ভালোবাসেন; বরং বান্দা না চাইলে তিনি ক্ষুব্ধ হন। প্রিয় নবী (সা.) দুনিয়া ও আখেরাতের সব ফেতনা, কবর ও জাহান্নামের শাস্তি থেকে বাঁচতে এই দোয়া বেশি পাঠ করতেন— ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিন আযাবিল কবরি, ওয়া মিন আযাবিন নারি, ওয়া মিন ফিতনাতিল মাহয়া ওয়াল মামাতি, ওয়া মিন ফিতনাতিল মাসিহিদ দাজ্জাল।’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই কবরের শাস্তি থেকে, জাহান্নামের শাস্তি থেকে, জীবন ও মরণের ফেতনা থেকে এবং মাসিহ দাজ্জালের ফেতনা থেকে।’ (বুখারি: ১৩৭৭)
তওবা-ইস্তেগফার করা
ফেতনা ও বিপদাপদের সময় যাবতীয় গুনাহ ও পাপের কাজ থেকে আল্লাহ তাআলার কাছে তওবা করা আবশ্যক। তওবা-ইস্তেগফারের গুরুত্ব, ফজিলত, প্রয়োজনীয়তা ও নির্দেশনা কোরআন-হাদিসের বিভিন্ন স্থানে নানাভাবে বিশদ বর্ণনায় ওঠে এসেছে। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা নিজেদের প্রতিপালকের কাছে (পাপের জন্য) ক্ষমা প্রার্থনা করো, অতঃপর তার কাছে তওবা (প্রত্যাবর্তন) করো।’ (সুরা হুদ: ৩)
আল্লাহর সিদ্ধান্তের প্রতি সন্তুষ্ট থাকা
মুমিন ব্যক্তি আল্লাহর নির্ধারিত সিদ্ধান্তের প্রতি সন্তুষ্ট থাকবে। পৃথিবীতে যা কিছু হচ্ছে ও হবে— সবই মহান আল্লাহর ইচ্ছাতেই হচ্ছে, এ কথার ওপর দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস রাখবে। আল্লাহ তাআলা এমন কোনো জিনিস সৃষ্টি করেননি যাতে শুধুমাত্র অকল্যাণ বিদ্যমান; বরং কখনো মুমিনের জন্য এমন বিষয় নির্ধারণ করেন, যা বাহ্যিক দৃষ্টিতে অকল্যাণকর মনে হয়, অথচ তাতে রয়েছে অপরিমিত কল্যাণ। কোরআনে আছে, ‘তোমরা এ ঘটনাকে অকল্যাণকর বলে মনে করো না; বরং এটি তোমাদের জন্য মঙ্গলজনক।’ (সুরা নুর: ১০)
বিভ্রান্তিকর প্রচারণা থেকে সাবধান থাকা
মিথ্যা সংবাদ প্রচারকারীরাই অনেক সময় নানা সমস্যা, ফেতনা ও বিপর্যয়ের কারণ হয়ে থাকে। তারা এমন সংবাদ প্রচার করে যা বাস্তবের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখে না। আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমাদের কাছে যদি ফাসেক ব্যক্তি কোনো খবর নিয়ে আসে, তোমরা তা যাচাই করে দেখ।’ (সুরা হুজুরাত: ৬)
ইবাদতে লিপ্ত থাকা
আমাদের সবসময় আল্লাহমুখী হতে হবে। আল্লাহকে স্মরণ করতে হবে। তার ইবাদত করতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ফেতনার সময় আল্লাহর ইবাদতে লিপ্ত থাকা আমার কাছে হিজরত করে আসার মতো।’ (মুসলিম: ২৯৪৮)
মুমিনদের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখা
ফেতনার সময় মুমিনদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা। তাদের সর্বপ্রকার সাহায্য-সহযোগিতা করা। আল্লাহ ও ইসলামের দুশমনদের ষড়যন্ত্র থেকে সাবধান থাকা। কারণ, বিপর্যয়ের ঘনঘটা প্রত্যক্ষ করে তারাও তখন হয়তো প্রত্যাশা করে থাকবে যে, তাদের মতোই অন্যরা, অর্থাৎ আমরাও যেন একই ভ্রান্ত পথের পথিক হই এবং পরিণামে ইহ-পরকালে বিপদগামী হই।
ফেতনার সময় ধৈর্যধারণ করা
মুমিন ব্যক্তির সব কাজই ভালো। কল্যাণ অর্জিত হওয়ার সময় যদি শুকরিয়া আদায় করে তবে তার জন্য তাই ভালো। আর বিপদাপদের সময় যদি ধৈর্যধারণ করে তাও তার জন্য ভালো। ‘নিশ্চয়ই ধৈর্যশীলদের প্রতিদান পরিপূর্ণ প্রদান করা হবে।’ (সুরা যুমার: ১০)
দ্বীনি জ্ঞানার্জনে গুরুত্ব দেয়া
দ্বীনের সঠিক জ্ঞান অর্জনই ফেতনা থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ যার কল্যাণ চান তাকে দ্বীনের জ্ঞান দান করেন।’ (বুখারি: ৭১) দ্বীনের জ্ঞান অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে শত্রুর চক্রান্ত, পরিকল্পনা ও তাদের অবস্থা সম্পর্কেও সম্যক ধারণা রাখতে হবে। যাতে তাদের অনিষ্ট থেকে বেঁচে থাকা যায়।
স্বস্তি ও আশার বাণী প্রচার করা
মুমিনের দুটি কল্যাণের একটি অবশ্যই অর্জিত হবে। একটি শাহাদাত ও অপরটি বিজয়। আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী! আপনি তাদের জিজ্ঞেস করুন! তোমরা কি আমাদের ব্যাপারে দুটি কল্যাণের একটির অপেক্ষায় আছ? আমরাও তোমাদের ব্যাপারে অপেক্ষায় আছি, হয়তো আল্লাহ তোমাদের নিজের পক্ষ থেকে অথবা আমাদের হাতে শাস্তি প্রদান করবেন। সুতরাং তোমরা অপেক্ষায় থাক, আমরাও তোমাদের সঙ্গে অপেক্ষা করতে থাকব।’ (সুরা তওবা: ৫২)
আল্লাহর চিরন্তন রীতির বাস্তবায়ন
মুমিন ব্যক্তি এ বিশ্বাস পোষণ করবে, বিশ্বসৃষ্টি ও পরিচালনায় মহান আল্লাহর কতিপয় নীতিমালা রয়েছে— যা কখনো পরিবর্তন হবে না। আল্লাহ বলেন, ‘তারা কেবল পূর্ববর্তীদের দশার অপেক্ষা করছে। অতএব, আপনি আল্লাহর বিধানে কোনো পরিবর্তন পাবেন না এবং আল্লাহর রীতি-নীতিতে কোনো রকম বিচ্যুতিও পাবেন না।’ (সুরা ফাতির: ৪৩)
সম্পদের ফেতনা
সম্পদ মানুষের ক্ষতির কারণ। সম্পদ অনেক সময় মানুষকে ধ্বংস করে ফেলে। এবং আল্লাহর আনুগত্য থেকে মানুষকে গাফেল রাখে। রাসুল (সা.) বলেন, প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোনো না কোনো ফেতনা ছিল। আর আমার উম্মতের ফেতনা হলো, ধন-সম্পদ।’ (তিরমিজি: ২৩৩৬)
লেখক: আলেম, প্রভাষক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব
আমাদের সর্বশেষ কথা
Your Code
You have to wait 30 seconds.