ভারী বৃষ্টিতে সিলেট-সুনামগঞ্জ সহ বিভিন্ন জেলার মানুষ যে ভয়াবহ বন্যার মুখোমুখি হয়েছে তাতে এখন আবারও নতুন করে আলোচনায় তবে কে সত্যি সত্যিই বাংলাদেশের বড় একটি অংশ ডুবে যাবে? একদিকে উষ্ণতা বাড়ছে পৃথিবীর অন্যদিকে আশঙ্কাজনকহারে গোলছে বরফ, তাল মিলিয়ে বারছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা, পরিবর্তন হচ্ছে জলবায়ুর, দেখা যাচ্ছে কখনও অতিবৃষ্টি আবার কখনো অনাবৃষ্টি, জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ার কারণে তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, সেই তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশও। ভয়াবহ এ আশঙ্কার ভিত্তিকে কোনভাবে কে এর মোকাবেলা সম্ভব এ নিয়েই এবারের পোস্টটি করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ডিপারটমেন্ট অব কমার্সের নেশনাল উনিভর্সিটি আদমিনিস্ট্রেশন ইন ও বলছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা দ্রুত গতিতে বেড়ে চলেছে বিশ শতকের তুলনায় উচ্চতা বৃদ্ধির হার বর্তমানে দ্বিগুণেরও বেশি, আগামী শতাব্দীর শুরুতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা 2000 সালের উচ্চতার তুলনায় এক ফুট বাড়বে বলে সতর্ক করেছে সংস্থাটি। অন্যদিকে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত ইন্টার্মেন্টাল প্যানেলের অনুমান অনুসারে 2100 সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা 16 থেকে 25 ইঞ্চি পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। ১৯৯৩ সাল থেকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতিবছর প্রায় তিন মিলিমিটার হারে বেড়ে��ে গত এক দশক ধরে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর ও পূর্ব ভারত মহাসাগরে সমুদ্র পৃষ্ঠ উচ্চতা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন এ শতকের শেষ এই পানির উচ্চতা এক মিটার বাঁধ তিন ফুটের কিছু বেশি বাড়বে, বিশ্বব্যাংক বলছে সমুদ্রের পানির উচ্চতা যদি দুই ফুট এর চেয়ে সামান্য বেশি বাড়ে তাহলেই বাংলাদেশের 40 ভাগ চাষযোগ্য জমির সমুদ্রের পানিতে তলিয়ে যাবে। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন আবহাওয়াজনিত চরম বিপর্যয়ের মুখে যে কয়টি দেশ রয়েছে তার মধ্যে প্রথম সারিতে বাংলাদেশের অবস্থান।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশে এখন জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য গ্রাউন্ড জিরো হিসেবে পরিচিত। ঢাকার সার্ক আবহাওয়া কেন্দ্র এর রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশের উপকূলের মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে সুন্দরবনের হিরনপয়েন্ট, হাতিয়ার চর্চাংগা ও কক্সবাজার। সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ায় সমুদ্রপৃষ্ঠের নিচে বসবাস করা এবং প্রতি বছর বন্যার সম্মুখীন হওয়া মানুষের সংখ্যা শতকরা প্রায় 75 ভাগ বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। মানবাধিকর কাউন্সিলের 48 তম অধিবেশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী 2050 সালের মধ্যে অর্থাৎ আর মাত্র 28 বছরের মাথায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের শতকরা প্রায় 17 ভাগ প্লাবিত হবে যে কারণে প্রায় 2 কোটি মানুষ বাস্তহারা হতে পারে বলেও সতর্ক করা হয়েছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের তথ্য অনুসারে 2100 সালের মধ্যে ধাকা লাব ব্যাংকক পুরোপুরি অথবা আংশিক ডুবে যেতে পারে এর মধ্যে ঢাকায় সবচেয়ে জনবহুল শহর।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি আছে। আগামী শতাব্দীর শুরুতে অসংখ্য মানুষের পুনর্বাসন এর প্রয়োজন হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য ইতোমধ্যে সলোমন দ্বীপপুঞ্জের পাঁচটি সবুজ প্রবালদ্বীপ ডুবে গেছে। এনভায়রনমেন্টাল রিচার্জ লেটার্স সাময়িকীতে প্রকাশিত 2016 সালের গবেষণা অনুযায়ী আরো 6 টি দীপ ডুবে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে, ঝুঁকিতে থাকা উল্লেখযোগ্য শহর গুলোর মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় অন্যতম। এক প্রতি মানুষের জাকার্তা কে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত ডুবে যাওয়া শহর হিসেবে অভিহিত করেছেন গবেষকরা। হংকংভিত্তিক অলাভজনক পরিবেশ সংস্থা অর্থের মধ্যে শহরটির প্রতিবছর 2 থেকে 4 ইঞ্চি পর্যন্ত ডুবে যাচ্ছে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলো বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হলেও এখানকার জনসংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম, সমুদ্রপৃষ্ঠের বাড়তে থাকা উচ্চতার জন্য প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপের বসবাসরত জনগোষ্ঠীর প্রায় সকলেই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এখানকার প্রায় 30 লাখ দ্বীপবাসি উপকূল থেকে 6.2 মাইল দূরবর্তী অঞ্চলে বসবাস করে অন্যদিকে জনবহুল দেশগুলোর ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা বেশি।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে চীন, দেশের 43 লাখ জনগোষ্ঠীর ঝুঁকিপূর্ণ উপকূলীয় অঞ্চলে বাস করে ইউরোপীয় ইউনিয়নে লাইফ এডাপ্টার প্রজেক্টে তথ্য অনুসারে 2100 সাল নাগাদ বাংলাদেশের তিন কোটি 20 লাখ এবং ভারতের দুই কোটি 70 লাখ জনগোষ্ঠী পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ঝুঁকিতে থাকবে। আরেকটি কম উচ্চতার বেশ হলো কিরিবাতি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে দেশটির উচ্চতা প্রায় 6 ফুট প্রশান্ত মহাসাগরের কেন্দ্রে অবস্থিত দেশটির জনসংখ্যা প্রায় 1 লাখ 20 হাজার, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা 3 ফুটবলের দুই-তৃতীয়াংশ ডুবে যেতে পারে। সমুদ্রপৃষ্ঠের দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন সমুদ্রের আয়তনের পরিবর্তনের অন্যতম কারণ, বরফ গলে যাওয়া মহাসাগরের উষ্ণায়ন এর তাপীয় সম্প্রসারণের কারণেই মূলত সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পায়, সমুদ্র হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পানির ঘনত্ব রাস পায় এবং আয়তন বৃদ্ধি পায় একে বলা হয় সামুদ্রিক তাপীয় সম্প্রসারণ আবার সমুদ্র উষ্ণ হয়ে ওঠার প্রধান কারণ বায়ুমন্ডলে গ্রিন হাউস গ্যাসের ঘনত্ব বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ,
তাপ ও পরিবহনের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর কারণে সবচেয়ে বেশি গ্রীন হাউজ গ্যাস নির্গমন হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত এক নতুন প্রতিবেদন বলছে বিশ্বে কার্বন নির্গমন যেভাবে চলছে তা কমানো না গেলে এখন থেকে আর 80 বছরের মধ্যে বাংলাদেশের এক বড় অংশ সাগরের পানির নিচে চলে যেতে পারে। গ্রীনল্যান্ড ও অ্যান্টার্কটিকায় জমে থাকা বরফ গলার হার দ্রুততর হয় এমন আশঙ্কার কথা জানানো হয়েছে, গ্রীনল্যান্ড ও অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলায় 80 লাখ বর্গ কিলোমিটার পরিমাণ ভূমি সাগরের পানিতে তলিয়ে যাবে যেখানে থাকবে বাংলাদেশের একটি বড় অংশ। কার্বন নির্গমন এখনকার হারে চলতে থাকলে ভবিষ্যতের পৃথিবী 5 ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতায় হবে বলে নতুন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন গবেষকরা। সেক্ষেত্রে 2100 সাল নাগাদ সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বাড়বে 62 সেন্টিমিটার থেকে 238 সেন্টিমিটার পর্যন্ত। দ্য নেচার কঞ্জারভেন্সী প্রস্তাবিত প্রতিরোধ ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে ম্যানগ্রোভ পুনরুদ্ধার সহ প্রবাল প্রাচীর স�্প্রসারণ কিন্তু এই বিষয়গুলো শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু জলবায়ু অঞ্চলের জন্যই প্রযোজ্য। তাছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই এসব পদক্ষেপ বেশ ব্যয়বহুল, নেদারল্যান্ডসের মতো দেশগুলো অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে বন্যা ঝুঁকি এড়াতে পারলেও দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর এক্ষেত্রে ঝুঁকিতে রয়েছে।
বন্যায় অবকাঠামোগুলো ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে ঘর ও রাস্তা উঁচু করার পাশাপাশি নিচু খোলা জায়গা রাখার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রভাব রোধে পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড বন্ধের পাশাপাশি উষ্ণায়ন রোধে কার্বন নিঃসরণের হার কমাতে বিশ্বনেতাদের আরো কার্যকর ভুমিকা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা।
Your Code
You have to wait 30 seconds.